সেদিন আকাশে মেঘ জমেছিল। কুচকুচে কালো মেঘ, সময়কে থমকে দিয়ে ভর দুপুরেই সাঁঝ নামিয়েছিল আমাদের মফঃস্বলে। মফঃস্বল না বলে গ্রাম বলাটাই অধিক শ্রেয়। কিন্তু আবার এ ঠিক অজপাড়া গাঁও নয়। এখানে স্কুল আছে, মাদ্রাসা আছে, ছোটখাট আট-দশটি দোকানের একটা বাজারও আছে। শহর এখান থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে,আর জেলা শহর বহু দূরে। গ্রামে বিদ্যুত পৌছেছে। তবে সে বিদ্যুৎ নামে মাত্রই গ্রামে আছে। সহজে তার দেখা পাওয়া ভার। এইরকম অবস্থায় হ্যারিকেন আর কুপিই ভরসা। আমি জানালার পাশে বসে আধাঁর নামা পৃথিবী দেখছিলাম। মা ঘরে ঢুকেই বললেন, ' তোর কি আক্কেল কোনদিনও হবে না তিলু? এই দুর্যোগে তুই জানালার পাশে বসে আছিস? আয়..কপাট বন্ধ করে এক্ষুনি উঠে আয়। '
আমি বিরক্তি নিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। ঘরের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মা হ্যারিকেল জ্বালিয়ে রেখে নিজে এসে জানালা বন্ধ করলেন। তারপর বললেন,
- তোর আহ্লাদীপনা গেল না এখনো। আর তো মোটে কটা দিন।তারপর যে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে,সেখানে এইসব আহ্লাদীপনা কে দেখবে শুনি?
আমি ঠোট উলটে বললাম, শ্বশুরবাড়ি যেতে আমার বয়েই গেছে।
- এহ!! কথা শোনো মেয়ের!!
বলি বাপ-মা কি চিরকাল থাকবে তোমর?কত কাল আর আইবুড়ো করে রাখব তোকে শুনি?
ওই যে সেদিন যারা দেখতে এসেছিল,তারাই বলে পাঠিয়েছে,তোকে তাদের পছন্দ। আগামী আশ্বিনেই বিয়ের কথা পাকা করছি আমরা বুঝলি।
কথাটি শোনা মাত্রই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। মা ততক্ষণে চৌকাঠ পেরিয়ে নেমে গেছেন বারান্দায়।
কিছুদিন আগে এক পক্ষ দেখতে এসেছিল আমাকে। দেখা দিয়েছিলামও,কিন্তু সত্যি সত্যিই বিয়ের কথা বাবা মা পাকা করে ফেলবে একবারো বুঝিনি। আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু উপচে এল। বাইরেও তখন গর্জন তুলে বৃষ্টি নেমেছে। মাতাল ঝড়ের তোপে গাছপালা ভেঙে পড়ার জোগাড়। তারসাথে পাল্লা দিয়ে আমার ভেতরেও ঝড় উঠলো। তীব্র অনুভূতি আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল আমাকে। এই কষ্টের নাম জানা নেই আমার। কেবল চোখের সামনে অস্পষ্ট একটা ছবি ভেসে উঠলো,যেন জল রঙে আকা কোন ঝাপসা ছবি। পরক্ষনেই সে ছবি স্পষ্ট হল।
মানুষ টা জহির ভাই। শুনেছিলাম,তিনি বাবার বন্ধুর ছেলে। একসময় সে বন্ধু বাবা কে কাজে অকাজে অনেক সাহায্য করেছিল। তাই তার অবর্তমানে জহির ভাই কে দেখা শোনার দায়িত্ব বাবার উপরেই পড়েছিল। জহির ভাই ছিল আমার বছর চারেকের বড়। হ্যাংলা,পাতলা,চোখে কালো ফ্রেমের চশমা,নাকের নিচে পাতলা গোঁফ,মুখে সদা হাসি হাসি ভাব এইসব নিয়েই ছিলেন তিনি। পড়াশুনোয় প্রচণ্ড মেধাবী ছিলেন। সারাদিন বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে রাখার পরও বাকি সময় টুকু খাটতেন আমাদের সংসারের পিছে। বাজার করা, বাবা কে নানা কাজে সাহায্য করা,সন্ধ্যে হলেই আমাকে নিয়ে পড়তে বসা আরও কত কি।
আমি ছোট থেকেই ছিলাম বড্ড চঞ্চল। পাড়ায় পাড়ায় হইহই করে ঘুরে বেড়ানো,এই গাছের বরই,ওই গাছের পেয়ারা চুরি করা ছিল আমার নিত্যদিনের কাজ। বিকেল নামতে না নামতেই পাড়ার অন্যসব ছেলে মেয়েদের একত্র করে ডাংগুলি, ছুটোছুটি এইসব ছেলেমানুষি খেলায় মেতে উঠতাম আমি । তবে এত কিছুর পরও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল,কারনে অকারণে জহির ভাইয়ের পিছে লাগা। সুযোগ পেলেই আমি জহির ভাইয়ের ঘরে গিয়ে হামলা চালাতাম। তার কবিতার বই,কিংবা হাবিজাবি লেখার খাতাটা লুকিয়ে ফেলতাম, জিনিস পত্র এলোমেলো করতাম। জহির ভাই ঘরে এসে তার বই,খাতা খুঁজে খুঁজে হয়রাণ হচ্ছেন,এইটা দেখতে ভীষণ মজা পেতাম আমি।
হুটহাট জহির ভাইয়ের পিঠে দুম করে কিল মেরে,কিংবা খানিকটা চুল টেনে দিয়ে দৌড়ে পালাতাম । আরো বেশি সমস্যায় পড়তেন, আমাকে পড়াতে বসলে। উদ্ভট সব প্রশ্ন করে তাকে নাজেহাল করতে ভালই লাগত।
এমন ভাবেই একদিন জহির ভাই আসন গেড়ে বসল আমার মনের মাঝে। আমি তখন কৈশোর পেরুচ্ছি। মনের মধ্যে সবসময় অদ্ভুত একটা শিহরণ, অনেক নাম না জানা অনুভূতি ডালপালা মেলছে অগোচরে। নতুন সব আবেগের কিশলয় গুলো মাথা উঁচিয়ে দাড়াচ্ছে সদর্পে। হঠাৎ আমি চুপসে গেলাম পুরোপুরি। আমার বাঁধভাঙা উচ্ছাস গুলো ক্রমেই হারিয়ে গেল। উচ্ছাসের জায়গা গুলো ঘিরে ধরল লজ্জা আর মুখচোরা অনুভূতি। জহির ভাইয়ের সাথে আগের মত আর ফাজলামি হত না। বরং তাকে দেখলেই বুকের মধ্যে আবেগের বজ্রপাত ঘটত। আমি তার চোখের আড়ালে থেকে লুকিয়ে তাকে দেখতাম। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।
এক পড়ন্ত দুপুরে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিলের ধারে দেখলাম তাকে। একা,হাতে তার কবিতার খাতা। শরৎ এর বিকেল তখন নামবে নামবে ভাব। সবে পশ্চিমে যাত্রা করা সূর্য তার কিরনরশ্মি কে বিলের স্বচ্ছ পানি তে প্রতিফলিত করতে মরিয়া। আমি হঠাৎই জহির ভাইয়ের হাতটা ধরলাম। চমকে উঠলেন তিনি,দ্রুত হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বললেন,
- কিছু বলবি?
আমি মাথা নাড়লাম। তার হাত তখনও আমার হাতের ভেতর। আমার দুচোখ ভর্তি টলটলে জল। বুকের ভেতর সহস্র ড্রাম হাতুড়ি পেটাচ্ছে। চোখ নাকি মনের আয়না। আমি প্রাণপণ চাইলাম, সে একবার বুঝুক,একটু আনুভব করুক। আমার দগ্ধ মন কে শান্ত করুক।
জহির ভাই তাকালেন আমার চোখের দিকে। আমি দেখলাম তার চোখেও বিস্ময় নিয়ে বিকেলের চঞ্চল রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে। কিন্তু মুহুর্তেই সে চঞ্চলতা দপ করে নিভে গেল। এক রাশ কালো মেঘ গ্রাস করল তাকে। জহির ভাই প্রায় ফিসফিস করে বললেন,
- তা হয়না রে তিলু। কাকা যে আমাকে বড্ড ভালবাসে। ভালবাসে তোকেও। কিভাবে তাকে আঘাত দিই বল?
আমি ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠি,
- কেন হয়না? যদি তুমি চাও...
জহির ভাই মুখে হাত দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিলেন তারপর হনহন করে বাড়ির পথ ধরলেন।
মুহুর্তেই আমি হারিয়ে ফেলি নিজেকে। অসহায় বোধ করি,পরাজিত হই। আমার চোখের দৃষ্টি ক্রমশ ঘোলা হতে থাকে। আমার সব কিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের সীমানা ঘেষে আমি কেবলই ছুটতে থাকি আর ছুটতে থাকি।
তারপর বেশ কয়েকদিন আমি জহির ভাইকে এড়িয়ে চলি পুরোপুরি। আমার পাহাড়সম অভিমান জমা হতে থাকে। কিন্তু তারপরও আনমনে চাইতে থাকি,একবার সে কথা বলুক,একবার হাত টা ধরে মেনে নিক আমার ভালবাসা। কিন্তু সেসব অধরাই থেকে যায়। সপ্তাহখানেক পরে শুনি, তিনি নাকি শহরে চলে যাচ্ছেন,সেখানে থেকেই পড়াশুনো করবেন। কয়েকদিনের মধ্যে সত্যিই তিনি চলে যান। যাওয়ার আগে আমার জন্য তার লেখা কবিতার খাতা টা রেখে যান, যে খাতা লুকিয়ে আমি অজস্র বার জহির ভাইকে চিন্তায় ফেলেছি।কিন্তু একবারও খুলে দেখার ইচ্ছে হয়নি। আমি ছুড়ে ফেলে দিই খাতাটা। অকাজের জিনিসের মধ্যে আটকা পড়ে তা আমার চোখের আড়াল হয়। আমার মনে ঝড় ওঠে সেদিন। সেই ঝড়ে আমি ঘুরপাক খেতে থাকি, চূর্ণবিচূর্ণ হই। প্রতিদিন চাপা আর্তনাদ আর হাহাকার তোলে আমার না পাওয়া ভালবাসাগুলো। আমার তৃষিত দৃষ্টি তাকে একবার দেখার আশায় পাগল প্রায় হয়ে ওঠে।
তারপর একদিন খেয়াল হল,মাঝে ৫ টি বছর কেটে গেছে। আর আমি বদলে গেছি অনেকখানি। জহির ভাইয়ের প্রতি রাগ,ক্রোধ নেই বললেই চলে। কেবল তীব্র বিষণ্ণতা রয়ে গেছে মন কে আচ্ছন্ন করে।
আমার বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। ইদানীং সময়ের বড্ড তাড়া। আমাদের উঠোন পেরিয়ে লম্বা দুখানা তালগাছের ফাক দিয়ে সূর্য্যি মামা উঠতে না উঠতেই দেখি ওপারে বিলের জলে আলো ফেলে সে ডুবতে বসেছে। ছোট চঞ্চলা চড়ুইয়ের মত ফুড়ুৎ করে চোখের পলকেই দিন গুলো কেটে যায়।
তারপর এক সকালে স্নান সেরে আমি লাল বেনারসি পড়ি। চোখে কাজল দিই, দুই ভ্রুকুঞ্চনের মাঝে একট সিঁদুররাঙা টিপ পরি।
সেদিন হঠাৎ করেই জহির ভাই এসে উপস্থিত হয়,৫ বছর পর। বাবা হাত ধরে তাকে নিয়ে এসে আমার সামনে দাড় করিয়ে দেয়। তারপর বলে ওঠে,
- দেখ রে তিলু, কে এসেছে!! তোর জহির ভাই।
আমি ঠিক জানতাম,যতই কাজ থাকুক,তোর বিয়ে তে ও না এসে পারবেই না।
আমি আমার কাজলে ঢাকা চোখ দিয়ে তার দিকে তাকায়। বদলে গেছে সে অনেকখানি। শুধু সেই প্রগলভ স্মিত হাসি রয়ে গেছে তার চোখে মুখে। বহুদিন পর আমার মনে আবার ঝড় ওঠে,ঠিক সেদিনের মত যেদিন তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। আমার তিব্র ভালবাসা কে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিলেন। রাগে, কষ্টে আমি চোখ ফিরিয়ে নিই। জহির ভাই বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
দুপুর হতে না হতেই বর পক্ষ আসে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় দ্রুতই। সবাই যখন ব্যস্ত,সেই ফাঁকে আমি খুঁজে বের করি তার দেয়া খাতাটি। এত গুলো বছর যা আমি সযত্নে রেখেছিলাম, অথচ খুলে দেখিনি একবারও।
খাতা খুলতেই চমকে উঠি আমি। গোটা অক্ষরে তিলোত্তমা নামটা চোখে পড়ে আমার। তারপর প্রতিটি পাতাতেই আমাকে নিয়ে লেখা অসংখ্য অনুভুতি কথা আমার মর্মে প্রতিধ্বনিত হয়।
সব শেষে ছোট্ট একটা চিঠি,
" তিলোত্তমা,
তোমার ভালবাসার যোগ্য হতে চললাম আমি। অপেক্ষা করো, আমি ফিরবোই।
ঠিকানা দিয়ে গেলাম,চিঠির প্রতীক্ষারত থাকবো "
আমি নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। এক অচেনা প্লাবন তখন আমার দৃষ্টি কে ক্রমাগত ঝাপসা করে চলেছে।